‘আমার কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো প্রমাণ নেই’, গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের এমন বক্তব্য ঘিরে দিনভর সমালোচনা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়কসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন। কেউ কেউ আবার অবিলম্বে রাষ্ট্রপতিকে গ্রেফতার করার দাবিও জানিয়েছেন। এরপর রাতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার বক্তব্য সুষ্পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের আড়াই মাস পর শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির ইউটার্ন এবং সমালোচনা শুরুর পর তার কার্যালয় থেকে আসা বিজ্ঞপ্তির পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, বঙ্গভবনে আসলে কী হচ্ছে?
মানবজমিনে রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎকার
গত ১৯ অক্টোবর মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে একটি সাক্ষাৎকার দেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। সাক্ষাৎকারটি মানবজমিন পত্রিকার রাজনৈতিক ম্যাগাজিন সংস্করণ ‘জনতার চোখ’- এ প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ প্রসঙ্গে কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।
সংবিধানের ৫৭ (ক) ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জানান, তার কাছে পদত্যাগপত্র বা সংশ্লিষ্ট কোনো প্রমাণ পৌঁছায়নি। রাষ্ট্রপতির ভাষ্যে, ‘আমি বহুবার পদত্যাগপত্র সংগ্রহের চেষ্টা করেছি, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। হয়তো তার সময় হয়নি’।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় গণভবন থেকে বঙ্গভবনে ফোন করে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এরপর প্রস্তুতিও শুরু হয়। কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন করে জানানো হয়, তিনি (শেখ হাসিনা) আসছেন না। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন, তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর। সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি’।
দিনভর সমালোচনার ঝড়
এদিকে রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। অনেকেই বলছেন, শেখ হাসিনা পালিয়েছেন, এটাই তো পদত্যাগপত্র। আলাদা করে আর পদত্যাগপত্রের দরকার কী? আবার কেউ কেউ বলছেন, রাষ্ট্রপতি এমন বক্তব্য দিয়ে শপথ লঙ্ঘন করেছেন। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও গ্রেফতারের দাবি উঠেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ৪৫ মিনিটে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, এটাই তো তার পদত্যাগপত্র। তাই আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের প্রয়োজন নেই।
এদিকে রাষ্ট্রপতিকে অবিলম্বে বহিষ্কার ও গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হারুনুর রশীদ। তিনি (রাষ্ট্রপতি) নিজেই তো জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। আমি জাতীয় সংসদ ভেঙে দিলাম’। অথচ এখন তিনি মিথ্যাচার করছেন। রাষ্ট্রপতিকে না সরানো হলে আমরা এখনই রাস্তায় নামবো।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আমরা কোনো বিপ্লবী সরকার গঠন করতে পারিন, পারিনি জাতীয় সরকারও গঠন করতে। এ কারণেই সাহাবুদ্দিনের মতো মানুষ এখনো রাষ্ট্রপতি পদে বসে আছেন। রাষ্ট্রপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছাত্রসমাজ নেবে।
আরেক সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘চুপ্পু সাহেব, এখনও সময় আছে, বঙ্গভবনের বিলাসিতা ছেড়ে নিজের পথ দেখুন।’
এদিকে দ্রুতই রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিতে রাজপথের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ।
রাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে সমালোচনায় শামিল হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
সোমবার আইন উপদেষ্টা বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্য মিথ্যাচার, শপথ লঙ্ঘনের শামিল। কারণ, উনি নিজেই ৫ আগস্ট রাত ১১টা ২০ মিনিটে পেছনে তিন বাহিনীর প্রধানকে নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী উনার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং উনি তা গ্রহণ করেছেন। বক্তব্যে অটল থাকলে তার রাষ্ট্রপতি পদে থাকার যোগ্যতা আছে কি না, উপদেষ্টা পরিষদ তা ভেবে দেখবে।
রাতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তি
এদিকে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরুর পর শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাতে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়।
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপপ্রেস সচিব শিপলু জামানের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন মিডিয়ায় যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সুস্পস্ট বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও দেশত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার ওপর যত ধরনের প্রশ্ন জনমনে উদ্রেক হয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উত্তর স্পেশাল রেফারেন্স নং-০১/২০২৪ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গত ৮ আগস্ট, ২০২৪ এর আদেশে প্রতিফলিত হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি গত ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ এ মতামত দিয়েছিলেন। মীমাংসিত এই বিষয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
স্পেশাল রেফারেন্সে যা আছে
স্পেশাল রেফারেন্সে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি বলেন, দেশের বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছেন, সেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ (৩) অনুসারে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করার বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ থেকে ০৮/০৮/২০২৪ তারিখের ১০.০০.০০০০.১২৭,৯৯.০০৭.২০.৪৭৫ নং স্মারকে প্রেরিত পত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত যাচনা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের বক্তব্য শোনা হলো। এ অবস্থায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কোনো বিধান না থাকায় উল্লিখিত প্রশ্নের বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই মতামত প্রদান করছে যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহী কার্য পরিচালনার নিমিত্ত অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি উক্তরূপে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করাতে পারবেন।