নারায়ণগগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্স কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ১৮২ জন নিখোঁজের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ওই ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, ‘অগ্নিসংযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর ৩২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করে জেলা প্রশাসন। যা সম্প্রতি প্রকাশ পায়।
প্রতিবেদনে ‘দুর্ঘটনায় আহত, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের বিবরণ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকার জন্য তদন্ত কমিটি গত ১ সেপ্টেম্বর গণশুনানির আয়োজন করে। ওই দিন ৮০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য দেন স্বজনরা। এছাড়া উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন তালিকা তৈরি করে। তালিকাগুলো একত্রিত করে ১৮২ ব্যক্তির নিখোঁজ থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনে গাজী টায়ার্সের অগ্নিকাণ্ডকে নিছক দুর্ঘটনা নয়, ‘অগ্নিসংযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ ঘটনার জন্য কারা দায়ী, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি।
প্রতিবেদনে আগুনের ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেফতার হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই দিন (২৫ আগস্ট) লোকজন আনন্দ মিছিল বের করে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খাদুন এলাকার খাঁ পাড়া জামে মসজিদ থেকে মাইকে কয়েকজন ব্যক্তি কারখানার ভেতরে যাদের জমি জোর করে দখল করা হয়েছে তাদের বিকেল ৩টার দিকে রূপসী বাসস্টেশনে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দেন। বেলা ১২টার দিকে লুটপাট করার উদ্দেশ্যে ‘দুষ্কৃতকারীরা’ কারখানায় প্রবেশ করে। তারা কারখানার ভেতরে থাকা শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বের করে লুটতরাজ শুরু করে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আরেকদল ‘দুষ্কৃতকারী’ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কারখানায় প্রবেশ করে। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে লুটপাটকারীদের একাধিক দলের মধ্যে কারখানার বাইরে ও ভেতরে বাকবিতণ্ডা ও সংঘর্ষ হয়। পরে খাঁ পাড়া মসজিদ থেকে পুনরায় ‘গাজীর কারখানায় ডাকাত ঢুকেছে’ ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীকে তাদের প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়। তাতে লুটপাট আরো বেড়ে যায়। লুটপাটকারীরা তখন কারখানা ছয়তলা ভবনটির বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং লুটপাট চালিয়ে যেতে থাকে।
আগুন দেয়ার ঘটনার পর কারখানার এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘দুপুর থেকে রাতে আগুন দেয়ার আগ পর্যন্ত টানা লুটপাট চলে। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য সেখানে যাননি।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টার দিকে লুটপাটকারীদের একটি দল ভবনের নিচতলায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেটের শাটারে তালা ঝুলিয়ে চলে যান। ওই সময় অনেকে ভবনটির উপরের অংশে লুটপাটে ব্যস্ত ছিলেন। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় দ্রুত প্রতিটি তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিটের টানা ২২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন পুরোপুরি নেভে পাঁচ দিন পর। দীর্ঘ সময় ধরে জ্বলতে থাকা আগুনে ভবনটি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হওয়ায় সেখানে উদ্ধার অভিযান চালানো যায়নি।
তদন্ত প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম সুপারিশে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি অপসারণের মাধ্যমে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেটি বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। ভবনটি ভাঙা হলে ভেতরে উদ্ধার কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। তবে ভবনটি ভাঙার কাজ করবে কারখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভবনটি তারা কবে ভাঙবেন এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি।
নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক আগুনের সূত্রপাত ও দায়ীদের চিহ্নিত করতে ২৭ আগস্ট তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন।